নামঃলাল টমেটো
বৈজ্ঞানিক নামঃ লাইকোপারসিকন লাইকোপারসিয়াম
বর্ণনাঃ টমেটো শীতের ফল হলেও এখন সারা বছরই পাওয়া যায়। তবে শীতের সময় এই সবজির স্বাদ অন্য সময়ের চেয়ে আলাদা। সালাদ হিসেবে ও রান্না টমেটো খুবই সুস্বাদু।
টমেটো চাষ করার পদ্ধতিঃ
টমেটো ভিটামিনসমৃদ্ধ বেগুন পরিবারের একটি প্রধান শীতকালীন সবজি। বাংলাদেশে যেসব সবজি চাষ করা হয় তার মধ্যে টমেটো অন্যতম। টমেটোতে ফলের সব গুণাগুণই রয়েছে। টমেটো একটি অত্যন্ত পুষ্টিকর সবজি। টমেটো দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। আসুন জেনে নেই টমেটো চাষ করার পদ্ধতি।
টমেটো চাষে প্রয়োজনীয় জলবায়ু ও মাটিঃ
টমেট চাষের জন্য মাঝারি উষ্ণ ও শুষ্ক পরিবেশ দরকার। সব ধরনের মাটিতে টমেটোর চাষ করা যায়। আলো-বাতাসযুক্ত উর্বর দোঁআশ মাটি টমেটো চাষের জন্য সবচেয়ে ভাল। তবে উপযুক্ত পরিচর্যায় বেলে দোঁআশ থেকে এটেল দোঁআশ সব মাটিতেই টমেটো ভাল জন্মে। টমেটোর ফল ধরার জন্য দিনের তাপমাত্রা ২৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এবং রাত্রিকালীন তাপমাত্রা ১৫ থেকে ২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড থাকা প্রয়োজন। তাই বাংলাদেশে শীতকালে টমেটো চাষের জন্য উপযুক্ত সময়। বন্যার সময় পলি জমে এমন জমিতে এর ফলন সরচেয়ে ভাল হয়। মাটির অ্ম্লতা বেশী হলে জমিতে চুন প্রয়োগ করা উচিত। আর্দ্র পরিবেশে টমেটো বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয় বলে সেচের সুবিধা আছে এমন উঁচু এলাকায় টমেটোর ফলন ও গুণাগুণ অপেক্ষাকৃত ভালো।
টমেটোর চারা তৈরি করাঃ
সবল চারা উৎপাদনের জন্য প্রথমে ৫০ গ্রাম সুস্থ বীজ ঘন করে প্রতিটি বীজতলায় (১ মিটার x ৩ মিটার) বুনতে হবে। শুকনা মাটিতে বীজ বপন করে সেচ দেয়া উচিত নয়, এতে মাটির চটা বেঁধে চারা গজাতে ও বাতাস চলাচলে অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে। তাই সেচ দেয়া মাটির জো অবস্থা এলে বীজ বপন করতে হয়। টমেটোর আগাম জাতের বীজ বপনের উপযুক্ত সময় হল জুলাই মাস থেকে সেপ্টেম্বর মাস। মাঝ মৌসুমি জাত সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর মাস। এবং নাবী জাতের ক্ষেত্রে সময় হল জানুয়ারী মাস। তবে টমেটো বীজ লাগানোর পূর্বে টমেটর বীজকে শোধন করে নিতে হবে। একটি গ্লাসে আধা গ্লাস ঠাণ্ডা পানি নিয়ে আধা গ্লাস সদ্য ফুটন্ত পানি মিশিয়ে নিয়ে সেই পানির তাপমাত্রা মোটামুটি ৫০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড হবে। সেই গরম পানিতে টমেটোর বীজ ৩০ মিনিট ভিজিয়ে রাখলে রোগজীবাণু মরে যায়।
অথবা টমেটোর বীজ বীজতলায় বপনের আগে প্রতি কেজি বীজে ২.৫ গ্রাম প্রোভেক্স বা ক্যাপটান বা ব্যাভিষ্টিন(Bavistin) ব্যবহার করে বীজ শোধন করা যায়। বীজ বপনের ৪ ঘণ্টা আগে প্রয়োজনমতো পানিতে বীজ ভিজিয়ে রাখা এবং নির্দিষ্ট পরিমাণ ছত্রাকনাশক পানিতে মিশিয়ে দেয়া হয়। বীজ বপনের ২ ঘণ্টা আগে বীজের পানি সেঁকে বীজকে ঝরঝরা করে তারপর বীজতলায় বপন করা হয়। বীজ শোধনের ফলে চারার বিভিন্ন ধরনের রোগ থেকে রক্ষা করা সম্ভব। রোদযুক্ত উঁচু জায়গা পরিষ্কার করে ভালভাবে মাটি চাষ দিয়ে বীজতলা তৈরি করতে হবে। অতিরিক্ত বৃষ্টি ও রোদের হাত থেকে রক্ষা করতে প্রয়োজন পলিথিন ও চাটাই এর আচ্ছাদন ব্যবহার করতে হবে। প্রতিশতক জমিতে চারা রোপণের জন্য মাত্র ১ গ্রাম বীজ বুনতে হবে।
টমেটো চাষের উপযুক্ত জমি তৈরি ও চারা রোপনঃ
টমেটো ক্ষেতে ভালো ফলন অনেকটাই নির্ভর করে জমি তৈরি করার উপর। জমি ৪ থেকে ৫ বার চাষ এবং মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে তৈরি করে নিতে হবে। জমি তৈরি করার পর সেচ দেওয়ার সুবিধার জন্য দু´টি বেডের মাঝে ৩০ সে.মি. নালা রাখতে হবে। চারার বয়স ৩০-৩৫ দিন অথবা ৪-৬ পাতা বিশিষ্ট হলে জমিতে রোপণ করতে হবে। বীজতলা থেকে চারা অত্যন্ত যত্নসহকারে তুলতে হবে যেন চারার শিকড় ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং কিছু মাটিসহ চারা ওঠাতে হবে। প্রতিটি বেডে দুই সারি করে চারা রোপণ করতে হবে। এক সারি থেকে অন্য সারির দূরত্ব ৬০ সে.মি. রাখতে হবে। এ জন্য চারা তোলার আগে বীজতলার মাটি ভিজিয়ে নিতে হবে। নভেম্বর থেকে জানুয়ারি মাস পর্যন্ত চারা রোপণ করা যায়। বিকালের পড়ন্ত রোদে চারা রোপণ করাই উত্তম এবং লাগানোর পর গোড়ায় হালকা সেচ প্রদান করতে হবে। চারা লাগানোর কয়েক দিন পর পর্যন্ত গাছে নিয়মিত পানি সেচ দিতে হবে।
টমেটো চাষে সার প্রয়োগ/ব্যবস্থাপনাঃ
গুণগত মানসম্পন্ন ভালো ফলন পেতে হলে টমেটো চাষের জমিতে যতটুকু সম্ভব জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। সম্পূর্ণ গোবর, টিএসপি, এমপি, মাত্রার বা ভেদের অর্ধেক ইউরিয়া সার শেষ চাষের সময় জমিতে ছিটিয়ে দিতে হবে। বাকি অর্ধেক ইউরিয়া সার সমান দুই কিস্তিতে চারা লাগানোর ১৫ ও ৩০ দিন পর প্রয়োগ করতে হবে। শেষ চাষের সময় প্রতিশতক জমির জন্য ২০ কেজি গোবর সার, ৩০০ থেকে ৪০০ গ্রাম এমওপি সার ও ৫০০ গ্রাম থেকে ১ কেজি টিএসপি সার জমিতে ছিটিয়ে দিতে হবে। টমেটো ক্ষেতে তিন কিস্তিতে ইউরিয়া সার প্রয়োগ করেতে হবে।
চারা রোপনের ২৫ দিন পর দ্বিতীয় কিস্তিতে সার প্রয়োগ করতে হবে। এরপরও যদি সারের ঘাটতি থাকে তাহলে জিপসাম, জিংক সালফেট, বোরিক এসিড পাউডার ও ম্যাগনেশিয়াম সালফেট সারও ব্যবহার করতে হবে। গুণগত মানসম্পন্ন ভালো ফলন পেতে হলে টমেটো চাষের জমিতে যতটুকু সম্ভব জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে।
টমেটো ক্ষেতে সেচ ও পানি নিষ্কাশনঃ
শুষ্ক মৌসুমে চাষ করলে টমেটোতে পানি সেচ দেয়া প্রয়োজন। ফসল ও মাটির অবস্থা বিবেচনা করে তিনবার সেচ দেয়া যেতে পারে। বৃষ্টির পানি নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে। টমেটোর চারা লাগানোর পর প্রথম সপ্তাহে প্রায় প্রতিদিন বিকাল বেলা সেচ দিতে হবে। এরপর প্রয়োজনে প্রতি সপ্তাহে বা ১৫ দিন পর পর একবার সেচ দিতে হবে। বর্ষা মৌসুমে তেমন একটা সেচের প্রয়োজন হয় না। টমেটো গাছ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না।
টমেটো ক্ষেতে আগাছা ও নিড়ানিঃ
টমেটোর জমি নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। প্রথম ও দ্বিতীয় কিস্তির সার প্রয়োগের আগে পার্শ্বকুশিসহ মরাপাতা ছাটাই করে দিতে হবে। হরমোন প্রয়োগ সুবিধা এবং বাতাসে যেন হেলে না পড়ে সেজন্য বাঁশের কঞ্চি দ্বারা ঠেকনা দিতে হবে। প্রতিটি সেচের পরে মাটির উপরি ভাগের চটা বা চাকামাটি ভেঙে দিতে হবে যাতে মাটিতে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচল করতে পারে।
পোকামাকড় ও রোগদমনঃ
টমেটো ক্ষেতে বিভিন্ন ধরণের পোকার আক্রমণ হয়ে থাকে। এর মধ্যে কিছু পোকা আছে অত্যন্ত ক্ষতিকর। যেমন ফল ছিদ্রকারী পোকা, কাটুই পোকা, পাতা সুড়ঙ্গকারী পোকা, বিছা পোকা, এফিড বা জাব পোকা, শ্যামা পোকা, ছাতরা পোকা এবং থ্রিপস পোকা। ভাইরাস রোগ হলে নির্দিষ্ট পোকা শনাক্ত করতে হবে এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। আর যদি গাছ বেশি আক্রান্ত হয় তাহলে গাছ তুলে ফেলে দিতে হবে।
টমেটোর চারা লাগানোর ২ থেকে ৩ মাসের মধ্যে টমেটো পাকতে শুরু করে। টমেটো পাকা অথবা কাঁচা উভয়ভাবে সংগ্রহ করা যায়। পুষ্ট ও রোগবালাই মুক্ত টমেটো সংগ্রহ করতে হবে। ফলের নিচে ফুল ঝরে যাওয়ার পর যে দাগ থাকে ঐ স্থান থেকে লালচে ভাব শুরু হলেই বাজারজাতকরণের জন্য ফল সংগ্রহ করতে হবে। এতে ফল অনেকদিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।
ফলনঃ
সময়মত সুষ্টু পরিচর্যার মাধ্যমে একর প্রতি ১০ থেকে ১৫ মেট্রিক টন টমেটোর ফলন পাওয়া যায়।
Reviews
There are no reviews yet.