নামঃ চায়না লম্বা মূলা
বৈজ্ঞানিক নাম: Raphanus sativus var.
বর্ণনাঃ মুলা বাংলাদেশের একটি অতি প্রচলিত শীতকালীন সবজি। সবুজ পাতায় প্রচুর পরিমাণে খাদ্যপ্রাণ ‘এ’ পাওয়া যায় যা বিশেষ করে শিশুদের রাতকানা রোগ নিরাময়ে ভূমিকা রাখে। এছাড়া মুলায় পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্যপ্রাণ ‘সি’ রয়েছে। খাদ্যপ্রাণ ছাড়াও মুলায় প্রচুর পরিমাণে আঁশ, আমিষ, শর্করা, চর্বি, ক্যালসিয়াম, লৌহ এবং ঔষধি গুণাগুণ বিদ্যমান। ভক্ষণযোগ্য (অপরিপক্ব) প্রতি ১০০ গ্রাম মুলায় শ্বেতসার ২৫.০০ গ্রাম, আমিষ ২.৫০ গ্রাম, ভিটামিন ‘বি-১’ ৩.১০ গ্রাম, ভিটামিন ‘বি-২’ ০.৩০ গ্রাম, ভিটামিন ‘সি’ ০.৯০ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ১৯০ গ্রাম, আয়রন ১.৪০ গ্রাম এবং ক্যারোটিন ৯০০০ আন্তঃএকক বিদ্যমান।
জলবায়ু ও মাটিঃ
মুলা প্রধানত শীত মৌসুমের সবজি। মুলা চাষের জন্য ১০০-১২০ সে. তাপমাত্রা ও কিঞ্চিৎ আর্দ্রতা সবচেয়ে উপযোগী। গ্রীষ্ম মৌসুমে চাষ করলে মুলা ঝাঁঝালো ও ফলন কম হয়। পানি সেচের ব্যবস্থা আছে এমন বেলে দো-আঁশ মাটি মুলা চাষের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট। তবে পলি দো-আঁশ ও এঁটেল দো-আঁশ মাটিসহ প্রায় সব মাটিতেই পরিমিত সার ও অন্যান্য খাদ্য উপাদান সরবরাহ করে প্রয়োজনীয় পরিচর্যা করলে লাভজনকভাবে মুলা চাষ করা যেতে পারে। মুলার জমির মাটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ রস থাকা বাঞ্ছনীয়।
জাতঃ
কিছুদিন পূর্বেও বাংলাদেশে জাপানি মুলা মিনোআর্লী, মিয়াশিগি ইত্যাদি জাতের মুলার চাষ করা হতো যেগুলো শংকর জাতের এবং এদেশের আবহাওয়ায় বীজ হয় না। এখন বাংলাদেশে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট মুলার চারটি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে। জাতগুলো স্থানীয় আবহাওয়ায় বীজ উৎপাদন করতে সক্ষম।
বারি মুলা-১ (তাসাকীসান মুলা)
এ জাতের মুলা ধবধবে সাদা এবং বেলুনাকৃতি। মুলা গড়ে ৪০ সেমি. লম্বা এবং ৭ সেমি. বেড় হয়। বীজ বপনের ৪৫ দিনের মধ্যেই মুলা বিক্রির উপযুক্ত হয়। হেক্টরপ্রতি মুলার ফলন গড়ে ৭৫ টন (৩০০ কেজি/শতাংশ)। স্থানীয় আবহাওয়ায় বীজ উৎপাদন করতে সক্ষম। বীজের ফলন হেক্টরপ্রতি ১.৫-২ টন (৬-৮ কেজি/শতাংশ)।
বারি মুলা-২ (পিংকি)
নলাকৃতি এ মুলা আকর্ষণীয় গোলাপি রংয়ের। গড়ে ৩০ সেমি. লম্বা এবং ৭ সেমি. ব্যাসযুক্ত। বীজ বপনের ৫০ দিনের মধ্যে সংগ্রহ করা যায়। এ জাতের মুলার ফলন হেক্টরপ্রতি ৬০ টন (২৪০ কেজি/শতাংশ)। এ দেশের আবহাওয়ায় বিশেষ করে উত্তারাঞ্চলে (রংপুর, দিনাজপুর) গড়ে প্রায় ১.০ টন (৪ কেজি/শতাংশ) বীজ উৎপাদন করতে সক্ষম। এটি কিছুটা নাবি জাতের মুলা
বারি মুলা-৩ (দ্রুতি)
এ জাতের মুলার রং ধবধবে সাদা ও আকৃতি অনেকটা নলাকার। এ জাতের মুলা বর্ধনশীল এবং ৪০-৪৫ দিনের মধ্যেই খাবার উপযোগী হয়। মুলার গড় ওজন ৫০০ গ্রাম ও লম্বা ২৫ সেমি.। মুলার গড় ফলন ৫৫ টন (২০০ কেজি/শতাংশ) প্রতি হেক্টরে। এ দেশের আবহাওয়ায় বীজ উৎপাদন করতে সক্ষম। বীজের ফলন হেক্টরপ্রতি ১.২ টন (৫ কেজি/শতাংশ)।
বারি মুলা-৪ (দ্রুতি)
মুলা লম্বাকৃতি ও ধবধবে সাদা বর্ণের। পাতা খাঁজকাটাবিশিষ্ট। প্রতিটি মুলার গড় ওজন ৭০০-৮০০ গ্রাম এবং লম্বায় ৩০-৩৫ সেমি.। হেক্টরপ্রতি মুলার ফলন ৬৫-৭০ টন। জাতটি দেশীয় আবহাওয়ায় হেক্টরপ্রতি ১.২-১.৫ টন বীজ উৎপন্ন হয়। জাতটির নাম চায়না।
জীবনকালঃ
জাতভেদে জীবন কালের কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে।
আগাম জাত : বীজ বপন থেকে মুলা উৎপাদন ৪৫-৬০ দিন।
নাবি জাত : বীজ বপন থেকে মুলা উৎপাদন ৭০-৭৫ দিন।
বীজ উৎপাদনের জন্য : বীজ বপন থেকে বীজ উত্তোলন পর্যন্ত ১৫০-১৮০ দিন।
বীজ বপনের সময়ঃ
আগাম ফসলের জন্য : সেপ্টেম্বর মাস
মাঝারি ফসলের জন্য : অক্টোবর মাস
নাবি ফসলের জন্য : নভেম্বর-ডিসেম্বর মাস
বীজ উৎপাদনের জন্য : অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বীজ বপন করতে হবে।
বীজের মাত্রাঃ
বীজের মাত্রা নির্ভর করে মুলার জাত, বপন পদ্ধতি এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্বের ওপর। প্রতি এক হাজার বীজের গড় ওজন ১০-১২ গ্রাম। এ হিসাবে প্রতি হেক্টর মুলা চাষের জন্য বীজ প্রয়োজন ২.৫ কেজি (১০ গ্রাম/শতাংশ)
সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি (হেক্টর ও শতাংশপ্রতি)/সারের নাম
মোট সারের পরিমাণ
ভার্মি কম্পোস্ট/কম্পোস্ট
১০ টন
৪০ কেজি
১০ টন
৪০ কেজি
ইউরিয়া
৩৭৫ কেজি
১.৫কেজি
১৮৭কেজি
৭০০ কেজি
৯৪ কেজি
৪০০ গ্রাম
৯৪ কেজি
৪০০ গ্রাম
টিএসপি
২২৫ কেজি
১ কেজি
২২৫ কেজি
১ কেজি
এমপি
২২৫ কেজি
১ কেজি
১১২ কেজি
৫০০ গ্রাম
৫৬ কেজি
২২৫ গ্রাম
৫৬ কেজি
২৫০ গ্রাম
জিপসাম
১০০ কেজি
৪০০ গ্রাম
১০০ কেজি
৪০০ গ্রাম
বোরাক্স
১০-১৫কেজি
৫০ গ্রাম
১০-১৫কেজি
৫০ গ্রাম
জমি তৈরিঃ
মুলা উৎপাদনের জন্য গভীর করে উপর্যুপরি চাষ দিয়ে জমি উত্তম রূপে তৈরি করা দরকার। মুলা বীজ সরাসরি জমিতে বপন করা হয়। তাই জমি তৈরির ওপর মুলার ফলন অনেকাংশে নির্ভর করে।
বীজ বপন পদ্ধতিঃ
মুলা বীজ সারিতে বপন করাই উত্তম। এজন্য জমি উত্তমরূপে তৈরি করার পর ৭৫ সেমি. প্রশস্থ ‘বেড’ তৈরি করতে হবে। বেডের উভয় কিনারে ১৫ সেমি. ছেড়ে দিয়ে বেডের লম্বালম্বি ৪৫ সেমি. দূরত্বে দুটি লাইন টানতে হবে। লাইন দুটি ১-২ সেমি. গভীর হতে হবে।
লাইনে ৩০ সেমি. দূরে দূরে ২-৩টি বীজ ফেলে যেতে হবে। বীজ বপনের সাথে সাথে দুইপাশের ঝুরঝুরে মাটি দিয়ে বীজ ভালোভাবে ঢেকে দিতে হবে।
দুই বেডের মাঝে ৩০ সেমি. চওড়া ও ১৫ সেমি. গভীর নালা থাকতে হবে।
বীজ বপনের পরপরই একটি সেচ দেয়া উত্তম।
পরবর্তী পরিচর্যাঃ
পাতলাকরণ : বীজ বপনের ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যেই ৩০ সেমি. দূরত্বে সবচেয়ে ভালো গাছটি রেখে বাকি সব গাছ পর্যায়ক্রমে উঠিয়ে ফেলতে হবে।
সেচ প্রয়োগঃ
মুলা চাষে প্রয়োজন মতো সেচ দেয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জমিতে রসের অভাব হলে ১০-১২ দিন পর পর মোট ৩-৪টি সেচ দেয়া মুলার বৃদ্ধির জন্য উত্তম।
আগাছা দমন ও মাটির চটা ভেঙে দেয়া
মুলার জমি সব সময় আগাছামুক্ত রাখতে হবে। এজন্য প্রয়োজনমতো নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার ও মাটির চটা ভেঙে দিতে হবে। এতে প্রচুর আলো বাতাস পেয়ে মুলা বৃদ্ধি পাবে।
ফসল সংগ্রহ ও ফলনঃ
বীজ বপনের ৪৫ থেকে ৬৫ দিনের মধ্যে মুলা উত্তোলন করে বাজারজাত করা যায়। এ সময় মুলা গড়ে ৫০০ গ্রাম থেকে ১ কেজি ওজনের হয়। এসব মুলা ৬০-৬৫ দিন পর্যন্ত আঁশহীন থাকে।
ফলন : প্রতি হেক্টরে ৬০-৭৫ টন (২৪০-৩০০ কেজি/শতাংশ)
বীজ উৎপাদনঃ
মুলা পরপরাগী উদ্ভিদ। সেজন্য বীজ ফসলের চারদিকে ১০০০ মিটারের মধ্যে অন্য কোনো মুলার জাত চাষ করা যাবে না। জাতের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য এ পৃথকীকরণ দূরত্ব অপরিহার্য।
বীজ ফসলের জন্য অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বীজ বপন করাই ভালো।
মুলার বয়স ৪০-৪৫ দিন হলে জমি থেকে সমস্ত মুলা উঠিয়ে জাতের বিশুদ্ধতা, আকৃতি, রোগবালাই ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করে মুলা বাছাই করতে হবে।
বাছাইকৃত মুলার মূলের এক-তৃতীয়াংশ এবং পাতার দুই-তৃতীয়াংশ কেটে ফেলতে হবে। মূলের কাটা অংশ ডায়থেন এম-৪৫ (২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে) এর দ্রবণে ডুবিয়ে নিতে হবে।
পরে প্রস্তুত করা বেডে সারি পদ্ধতিতে ৪০ সেমি. x ৩০ সেমি. দূরত্বে মুলা গর্তে স্থাপন করে পাতার নিচ পর্যন্ত মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।
এ পদ্ধতিতে পুনরায় রোপণকৃত গাছ থেকে অধিক পরিমাণে উন্নত মানের বীজ পাওয়া যায়।
বীজ-ফসলের জমিতে ১০-১৫ দিন অন্তর সেচ দিতে হবে।
গাছে ফুল আসার পর হেক্টরপ্রতি অতিরিক্ত ১০০ কেজি ইউরিয়া ও ১০০ কেজি এমপি সার বেডে ছিটিয়ে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।
প্রতিকূল আবহাওয়ায় বীজ-ফসল যাতে হেলে না পড়ে সেজন্য ঠেকনা দিতে হবে।
মুলার বীজ ফসলে জাবপোকা দেখা দেয়া মাত্র প্রিমোর-জোলন-ম্যালাথিয়ন কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে ২.০ মি.লি হারে মিশিয়ে ৭-১০ দিন অন্তর প্রে করতে হবে।
অল্টারনারিয়া লিফ স্পট যদি মুলার পাতায় ও পডে (চড়ফ) দেখা দেয় তবে বীজ পরিপুষ্ট না হয়ে চিটা হয় এবং বীজের ফলন কমে যায়। এর প্রতিকার হিসেবে প্রতি লিটার পানিতে ২.০ গ্রাম রোভরাল মিশিয়ে গাছে ১০-১২ দিন অন্তর স্প্রে করতে হবে।
বীজ বপনের পর ৫-৬ মাসের মধ্যেই বীজ সংগ্রহের উপযুক্ত হয়।
বীজের ফলন : হেক্টরপ্রতি বীজের ফলন ১.৫-২.০ টন পর্যন্ত হতে পারে।
Reviews
There are no reviews yet.